যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন : ভোট জালিয়াতির পাঁচটি অভিযোগ তদন্ত করে যা পেয়েছে বিবিসি

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে অব্যাহতভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর থেকেই ভোট সম্পর্কে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর নানা পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে।

কোন তথ্যপ্রমাণ না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তৃতা-বিবৃতিতে এরকম বেশ কয়েকটি পোস্টের কথা উল্লেখ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রচারণা শিবির।

এরকম প্রধান পাঁচটি অভিযোগ খতিয়ে দেখেছে বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিম।

মিশিগানে কি মৃত ব্যক্তিদের নামে ভোট দেয়া হয়েছিল?

টুইটারে ভাইরাল হওয়া বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের অন্যতম প্রধান একটি অঙ্গরাজ্য মিশিগানে মৃত ব্যক্তিদের নামে ভোট দেয়া হয়েছে।

এসব দাবিকে ‘ভুল তথ্য’ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে মিশিগানের কর্তৃপক্ষ। তারা আরও জানিয়েছে, মৃত ব্যক্তিদের নামে কোন ভোট আসলে সেটা বাতিল করে দেয়া হয়।

ভাইরাল টুইটগুলোয় এরকম কয়েকজন ব্যক্তির উল্লেখ করা হয় যাদের নামে অ্যাবসেন্টি ব্যালট (ডাক যোগে দেয়ার জন্য ভোট) পাঠানো হয়, যাদের জন্ম হয়েছিল শতবর্ষ আগে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে।

টুইটারে ভাইরাল হওয়া বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের অন্যতম প্রধান একটি অঙ্গরাজ্য মিশিগানে মৃত ব্যক্তিদের নামে ভোট দেয়া হয়েছে। এসব দাবিকে ‘ভুল তথ্য’ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে মিশিগানের কর্তৃপক্ষ।

এরকম একটি টুইট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যার নাম সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তার পিতার নামের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।

পলিটিফ্যাক্ট ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তার পিতার মৃত্যু হয়েছে। যদিও তাদের নাম এবং ঠিকানা এক। মিশিগানের কর্মকর্তারা ওই সাইটটিকে জানিয়েছেন, ছেলের ব্যালট ভুল ভাবে পিতার নামে ভোটিং সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

মৃত ব্যক্তিদের নামে ভোট দেয়ার আরও কয়েকটি অভিযোগ খতিয়ে দেখে বিবিসি দেখতে পেয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবার এবং ছেলের নাম এক থাকায় এরকম বিভ্রান্তির তৈরি হয়েছে। আবার প্রযুক্তিগত ক্রুটির কারণেও এমন ঘটেছে। যেমন অনেক সময় ভোটারদের একটি সাজানো জন্ম তারিখ দিতে বলা হয়েছিল, কারণ প্রাথমিকভাবে অনলাইনে তারা ভোটার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র (যিনি নিজেও বাবার নাম শেয়ার করেন) এবং ব্রেক্সিট পার্টি নেতা নাইজেল ফারাজের একাউন্ট থেকেও এসব গুজব অনেকবার শেয়ার করা হয়েছে।

মিশিগানে কম্পিউটার সফটওয়্যারে ভুল ছিল না

অনলাইনে একটি পোস্ট অসংখ্যবার শেয়ার করা হয়েছে যে, মিশিগানে কম্পিউটারের একটি সফটওয়্যারের ভুলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে জমা পড়া ভোট জো বাইডেনের নামে গণনা করা হয়েছে।

রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের একটি টুইট, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় টুইট করেছিলেন-সেটার কারণে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বলা হয়, রাজ্যজুড়ে যে সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে সমস্যা থাকতে পারে।

অনলাইনে একটি পোস্ট অসংখ্যবার শেয়ার করা হয়েছে যে, মিশিগানে কম্পিউটারের একটি সফটওয়্যারের ভুলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে জমা পড়া ভোট জো বাইডেনের নামে গণনা করা হয়েছে। তবে মিশিগানের সেক্রেটারি অব স্টেট জোসেলিন বেনসন জানিয়েছেন, খুব দ্রুত সেটা ধরা পড়ে এবং সংশোধন করা হয়।

শুধুমাত্র একটি কাউন্টিতে (অঙ্গরাজ্যের একেকটি ছোট এলাকা) প্রাথমিকভাবে এরকম একটি সমস্যা হয়েছিল, যেখানে ভোট ভুল ক্রমে মি. বাইডেনের নামে জমা পড়েছিল। তবে মিশিগানের সেক্রেটারি অব স্টেট জোসেলিন বেনসন জানিয়েছেন, খুব দ্রুত সেটা ধরা পড়ে এবং সংশোধন করা হয়।

তিনি জানিয়েছেন, প্রাথমিক এই ভুলটি মানুষের ভুল, কোন সফটওয়্যারের ভুল নয়।

ভাইরাল পোস্টে দাবি করা হয়েছে, মিশিগানের অন্য ৪৭টি কাউন্টিতে একই ধরণের সমস্যার তৈরি হতে পারে, যেখানে একই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে।

মিসেস বেনসন বলেছেন, রাজ্যজুড়ে একই ভুল হয়েছে, এরকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

‘শার্পি’ কালির ভোট বাতিল হয়নি

আরেকটি ব্যাটেলগ্রাউন্ড অ্যারিজোনায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া গুজব ছিল, রিপাবলিকান ভোটারদের ভোট দেয়ার সময় শার্পি কলম (পার্মানেন্ট মার্কারের একটি ব্রান্ড)দেয়া হয়েছিল।

ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে একজন নারী ব্যাখ্যা করেন যে, কীভাবে এই ধরণের কালিতে দেয়া ভোট মেশিনগুলো পড়তে পারে না।

ক্যামেরার পেছনে থাকা একজন ব্যক্তি বলেন, এসব ভোট গণনা করা হচ্ছে না এবং ভোট নষ্ট করার উদ্দেশ্যেই মানুষজনকে শার্পি পেন ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টে দাবি করা হয়, ভোটে জালিয়াতি করা হয়েছে এবং ট্রাম্প ভোটারদের অনেক ভোট এভাবে বাতিল করা হয়েছে।

কিন্তু এই দাবি মিথ্যা।

মারিকোপা কাউন্টির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শার্পি কলম ব্যবহারের কারণে কোন ভোট বাতিল হয় না।

মারিকোপা কাউন্টির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শার্পি কলম ব্যবহারের কারণে কোন ভোট বাতিল হয় না।

অ্যারিজোনার সেক্রেটারি অব স্টেট কাটি হোবস টুইটারে নিশ্চিত করেছেন যে, আপনি যদি সশরীরে ভোট দিয়ে থাকেন, আপনার ভোট গণনা করা হবে। কি ধরণের কলম আপনি ব্যবহার করেছেন (শার্পি হলেও), সেটা কোন ব্যাপার না।

পরে তিনি সিএনএনকে বলেছেন, যদি কোন কারণে যন্ত্র কোন ভোট গণনা করতে না পারে, তারপরেও আমাদের সেগুলো গণনার পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলোও গণনা করা হবে। রিপাবলিকানদের ভোট বাতিল করার উদ্দেশ্যে এরকম ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, এরকম দাবির পেছনে আসলে কোন ভিত্তি নেই।

মিশিগানের ভুল ভোট মানচিত্র

নির্বাচনের রাতে ছড়িয়ে পড়া মিশিগানের একটি ভোট মানচিত্র- যেখানে দেখা যায় যে, হঠাৎ করে জো বাইডেনের জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার ভোট বেড়ে গেছে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কোন ভোট বাড়েনি- সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

ছবিটি নিজেও শেয়ার করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার ফলে ভোট জালিয়াতির আলোচনা আরও বেড়ে যায়।

এটা আসলে খুব সাধারণ যে, ভোট গণনার হিসাবে রাজ্য কর্মকর্তা গণনা হওয়া ভোটের বড় একেকটি অংশ একেকবারে যোগ করে থাকেন।

কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রশ্ন হলো, এই আপডেটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে কোন ভোট জমা হয়নি কেন।

এর উত্তর হলো: এটা ছিল তথ্য অন্তর্ভুক্তির একটি ভুল, যা পরে সংশোধন করা হয়।

ম্যাট ম্যাকোউইক, যার পোস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় টুইটারে শেয়ার করেছিলেন, তিনি নিজেই পোস্টটি মুছে ফেলে ক্ষমা চেয়েছেন-যদিও ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার কারণে ছবিটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় রয়ে গে

ম্যাপটি যারা তৈরি করেছিল, সেই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ওয়েবসাইট ডিসিশন ডেস্ক জানিয়েছে, ”এটা ছিল রাজ্যের তৈরি করা ফাইলের সাধারণ একটি ভুল- যা ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রাজ্য যখন ভুলটি শনাক্ত করে, তখন তারা আরেকটি আপডেটেড হিসাব পাঠিয়ে দেয়।”

”নির্বাচনী রাতে এ ধরণের ভুল ঘটতে পারে এবং আমাদের ধারণা, মিশিগানের অন্য যারা ভোটের হিসাব রেখেছেন, তারাও একই ভুল করেছেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মতো তারাও সংশোধন করেছেন।” সংস্থাটি বলছে।

এনিয়ে যারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাদের পোস্টের সঙ্গে টুইটার একটি করে লেবেল সেটে দিয়েছে যে, ‘এই টুইটে আংশিক বা পুরো তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে এবং তা নির্বাচন বা নাগরিক প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।

ম্যাট ম্যাকোউইক, যার পোস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় টুইটারে শেয়ার করেছিলেন, তিনি নিজেই পোস্টটি মুছে ফেলে ক্ষমা চেয়েছেন-যদিও ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার কারণে ছবিটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে মিশিগানের ব্যুরো অব ইলেকশন বলেছেন, তথ্য গরমিল নিয়ে তারা কোন মন্তব্য করবে না। তবে জানিয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল এখনো অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে রয়েছে এবং চূড়ান্ত গণনা সম্পন্ন হয়নি।

তালিকাভুক্ত ভোটারদের চেয়ে উইসকনসিনে বেশি ভোটার নেই

ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি মিথ্যা দাবি হলো যে, উইসকনসিনে মোট যতজন ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছেন, তাদের চেয়ে বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন।

একজন টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, ”ব্রেকিং: উইসকনসিনে তালিকাভুক্ত ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে। তালিকাভুক্ত ভোটার-৩১,২৯,০০০ অথচ ভোট পড়েছে ৩২,৩৯,৯২০টি। এটা জালিয়াতির সরাসরি প্রমাণ।”

কিন্তু ভোটার সংখ্যার তার তথ্যটি পুরনো। পহেলা নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, উইসকনসিন রাজ্যে ভোটারের সংখ্যা ৩৬,৮৪,৭২৬ জন।

ওই টুইটটি এখন মুছে ফেলা হয়েছে। তবে সেটার একটা ছবি এখনো শেয়ার করে চলেছেন ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারকারীরা।

গত কয়েক বছরের তুলনায় উইসকনসিনে ভোট পড়ার হার এই বছর বেশ বেশি।

এই অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনের দিনেও একজন নিজেকে ভোটার হিসাবে তালিকাভুক্ত করতে পারেন। এর মানে হলো তালিকাভুক্ত ভোটারের সর্বশেষ যে সংখ্যাটি পাওয়া যাচ্ছে, নির্বাচনের দিন সেই সংখ্যা আরও বাড়তেও পারে।

আপনি আরও পড়তে পারেন